

বছরের পর বছর নানা অনিয়ম, দখল ও বন ধ্বংসের অভিযোগের পর বনবিভাগের ভিলেজার প্রথা আইন বাতিল হয়েছে বহু আগেই। কিন্তু মাঠপর্যায়ে সেই প্রথার ভূত যেন এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বত্রে।
উখিয়া রেঞ্জের উখিয়ারঘাট বিট এলাকায় ২০২৪ সালে দায়িত্বে থাকা বিট কর্মকর্তা কামরুল হাসানের স্বাক্ষরিত একটি কাগজে ৯ একর বনের জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ভিলেজার দেখিয়ে। সেই বনের জমিতে ওই ব্যক্তির মালিক ও ওয়ারিশদাররা অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এমন অভিযোগে তোলপাড় চলছে স্থানীয়দের মাঝে।
★ সরকারি বনায়ন নেই
★ চলছে বনের জমিতে ভাড়া বাণিজ্য
★ চারদিকে স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক
★ বন ধ্বংসে ভিলেজার পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক শ্রেণীর লোক
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, উখিয়ার ঘাট বিটের অধিকাংশ বনাঞ্চল এখন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আওতাভুক্ত। ২০২৪ সালের শুরুতে ‘ভিলেজার’ দেখিয়ে বরাদ্দ দেওয়া প্রায় ৯ একর বনজমির একটি অংশও ক্যাম্পের ভেতর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পড়ে। ফলে জমিটির বাজারমূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বন কর্মকর্তা কামরুল হাসানের সহযোগিতায় ওই জমিতে স্থাপনা নির্মাণ, বিভিন্ন এনজিওকে ভাড়া দেওয়া এবং ভিলেজারের নামে লিখিত নথি সংগ্রহের মতো নানা কৌশল গ্রহণ করা হয়-যাতে পরবর্তীতে কেউ মালিকানা বা বরাদ্দ নিয়ে দাবি করতে না পারে।
সেখানে তারা কেউ দোকান,কেউ ঘর,কেউ এনজিওর স্কুলসহ বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে। মাসে বা এককালীন চুক্তিতে এসব ভাড়ায় চলছে। কেউ আবার দালান ও নির্মাণ করেছে। কিছু ভাড়ায় চলছে, কিছু নিজেরায় ভোগ করছে। এভাবেই পুরো ৯ একর বনের জমি ব্যক্তিমালিকানার ভোগদখলে দিয়ে বনায়নের জায়গাকে ধ্বংশ করে দিয়েছে বন-কর্মকর্তা কামরুল হাসান।
এ বিষয়ে বিট কর্মকর্তা কামরুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি এখন উখিয়ারঘাটে নেই, ইনানী সদর বিটে কর্মরত আছি। উখিয়ারঘাটে দায়িত্বে থাকাকালীন ২০২৪ সালে ভিলেজারের পরিচয় দেখিয়ে কাউকে বনের জমি দেওয়া হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এরকমভাবে কাউকে জমি বা নতুন ভিলেজার দেওয়া হয়নি।
তাকে জিজ্ঞেস করা হয়-তাহলে ২০২৪ সালের আপনার স্বাক্ষরযুক্ত কাগজ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কীভাবে দেখাচ্ছেন? জবাবে তিনি বলেন, কাগজটা আমাকে দেন। কাগজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর আবার প্রশ্ন করা হয়- বর্তমানে ভিলেজার দেখিয়ে এভাবে কাগজ বা জমি দেওয়ার কোনো নিয়ম আছে কি না? এর উত্তরে তিনি বলেন, এগুলো পুরোনো ভিলেজারদের ওয়ারিশদের দেওয়া হয়েছে, নতুন কাউকে নয়।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভিলেজার কাগজের বর্তমানে কোনো বৈধতা নেই। ভিলেজার প্রথাও এখন আর চালু নেই। তাই ভিলেজার পরিচয় দেখিয়ে কেউ যদি বনের জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করে বা ভাড়া তুলে থাকে, তা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আইন অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
স্থানীয়দের অভিযোগ , শত বছর আগে ভোগদখলীয় বনের জমিতে একটি বাশের ঘর নির্মাণ করতে গেলে বনবিভাগের লোকজন এসে বাধা দেয়। আর স্থাপনা নির্মাণ করলে ভেংগে দেয় না হলে মামলা দেয়। বাকিরা ভিলেজার বলে তারা সব পাবে এমন তো হতে পারে না।
স্থানীয় এক গনমাধ্যম কর্মী বলেছেন, বনের জমি দখল হচ্ছে, আর বনবিভাগ অনেক সময় দেখেও না দেখার ভান করছে। সরকারি জমিতে দোকান-বাড়ি তুলে ভাড়া নেয়-এটা কীভাবে সম্ভব? দেশে আইন দুই রখম আছে নাকি। বনবিভাগকে কাউকে বুকে কাউকে পিঠে নেওয়ার সুযোগ কে দিয়েছে তা সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করছি।
বনবিভাগের একাধিক বন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ভিলেজার প্রথা বাতিল হওয়ার পরও মাঠপর্যায়ে আগের কিছু কাগজপত্র বা মৌখিক অনুমতির সুযোগ নিয়ে অনেকে মালিকানা দাবি করে গোপনে দখল বাড়িয়ে নেয়। নিয়মশৃঙ্খলার বাইরে এসব বরাদ্দ বা ‘দখল স্বীকৃতি’ কোনোভাবেই বৈধ নয়।
তারা আরও বলেন, এসব ক্ষেত্রে তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা জানা প্রয়োজন। সরকারি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ বা ভাড়া নেওয়া আইনত দণ্ডনীয়।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী ও সাধারণ মানুষ এই বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের বক্তব্য
সরকারি জমি ব্যক্তিগত আয়-উপার্জনের উৎস হতে পারে না, অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে বনকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি, দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এক পরিবেশকর্মী বলেন, ‘বনভূমি দখল মানে শুধু সরকারি ক্ষতি নয়-এটা পরিবেশেরও ক্ষতি। উখিয়ার বনাঞ্চল আগেই সংকুচিত। এখন আবার ভাড়া বাণিজ্য শুরু হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
এ বিষয়ে উখিয়া রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়েও সাড়া মেলেনি।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, বর্তমানে বনে ‘ভিলেজার’ নামে কোনো প্রথা কার্যকর নেই। ভিলেজারের নাম ভাঙিয়ে কাউকে বনের জমি ভোগদখলে দেওয়ার বৈধতা কারো নেই। আমি সদ্য দায়িত্ব নিয়েছি-বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। অভিযোগের সত্যতা মিললে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত